ধানের শীষের প্রার্থীদের কাল ঢাকায় ডাক

নির্বাচনের পর আপাতত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখবে বিএনপি ও তার দুই জোটসঙ্গী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০-দলীয় জোট। নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিষয়ে সরকারের মনোভাবের দিকেও নজর রাখবে তারা।

সদ্য অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে পুনঃভোট দাবি করেছে বিএনপি জোট। তবে এই দাবির পক্ষে চলমান পরিস্থিতিতে কঠোর বা বড় কোনো কর্মসূচিতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জোট দুটি। এই অবস্থায় কাল বৃহস্পতিবার ধানের প্রার্থীদের ঢাকায় ডেকেছে বিএনপি।

নির্বাচন ও পরবর্তী পরিস্থিতি এবং করণীয় নিয়ে গত কয়েক দিনে অনানুষ্ঠানিক একাধিক বৈঠক করেন বিএনপি জোটের নেতারা। এর মধ্যে গত সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে তিন দফা বৈঠক করেন তারা। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিকালে দলটির স্থায়ী কমিটি, পরে সন্ধ্যায় ২০-দলীয় জোট নেতারা বৈঠক করেন। এর পর রাতে মতিঝিলে ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের চেম্বারে বৈঠক হয়।

এসব বৈঠকের পর ড. কামাল হোসেন বলেন, সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কল্পিত নির্বাচনের ফল ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। এ নির্বাচন বাতিল করে পুনর্নির্বাচনের দাবিতে ফ্রন্টের প্রার্থীরা নির্বাচন কমিশনে ৩ জানুয়ারি স্মারকলিপি প্রদান ও কর্মসূচি ঘোষণা করবেন।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আমাদের সময়কে বলেন, পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে, একেবারে বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে নজিরবিহীনভাবে একটা যুদ্ধাবস্থা তৈরি করে ত্রাস-ভীতি সৃষ্টি করে এই নির্বাচনটি করা হয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, এ ধরনের নির্বাচন হবে, এ ধারণা আমরা আগেই করেছিলাম। এখন আমাদের সমানে এগোতে হবে। নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করতে নানা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকতে হবে। দলকেও পুনর্গঠনে হাত দিতে হবে। বিএনপি এখন কী করবে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বলেন, আমরা দেখে শুনে সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। কারণ নেতাকর্মী, সমর্থক সবাই জানেন তাদের জয় কীভাবে ছিনিয়ে নিয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বৈঠকে নেতারা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, এবারের নির্বাচনে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি করে ধানের শীষের বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। বৈঠকে একাধিক নেতা বলেন, ভোটের আগের রাত থেকে কেন্দ্র দখল করে নৌকা প্রতীকে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয়েছে। এ কাজে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও স্থানীয় প্রশাসন সহযোগিতা করেছে। ভোটের দিন ধানের শীষের পোলিং এজেন্টদের বের করে দিয়ে ভোট কারচুপি করা হয়েছে। এ কারণে দুপুরের মধ্যে কোনো কোনো কেন্দ্রে ব্যালট শেষ হয়ে যায়। এভাবেই জনগণের বিজয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছিনিয়ে নেয়। তাদের মতে, তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে প্রার্থীদের প্রচারে বাধাসহ ভোটের আগের রাতে থেকে ভোটের দিনের নানা অনিয়মের চিত্র দেশীয় গণমাধ্যমে স্থান না পেলেও বিদেশি গণমাধ্যমে তা এসেছে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে।

নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার সিদ্ধান্ত থাকলেও বিএনপি জোটের ৬৯ প্রার্থীর নানা অনিয়মের প্রতিবাদে ভোট বর্জনকে বৈঠকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেন স্থায়ী কমিটির নেতারা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত জনগণ জানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় কীভাবে ভোট ডাকাতি হয়েছে। বিএনপি জোট এত জনপ্রিয় ছিল বলেই সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনের সাহস দেখায়নি। তারা নার্ভাস ছিল। প্রশাসনকে ব্যবহার করে তাই তাদের ভোট ছিনিয়ে নিতে হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমরাই জয়ী হতাম।

বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, তারা অনেক আগেই ধারণা করেছিলেন, দলীয় সরকারের অধীনে এমন নির্বাচনই হবে। দলীয় ফোরামে তা তুলেও ধরা হয়েছিল। স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান, মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বরচন্দ্র রায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তবে দলের অন্যদের বক্তব্য ছিল-ভোটবিপ্লব হলে কোনো অনিয়মই ধানের শীষের বিজয়কে ঠেকাতে পারবে না। এই দুই মতের নেতারাই এখন একমত, এবারের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন ঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। যদিও ওই সময়ে অনেকেই বলেছিলেন, ওই নির্বাচন বর্জন ছিল বিএনপির ভুল সিদ্ধান্ত।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির দুই নেতা বলেন, আমরা এখন অতীতের ভুলভ্রান্তি দূর করে সামনের দিকে এগোনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নানা কর্মসূচি দিয়ে সারাদেশের নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করা হবে। এখন থেকে তরুণ-প্রবীণ সমন্বয়ে দল পুনর্গঠন করা। যারা বয়সের ভারে ন্যুব্জ তাদের সম্মানের সঙ্গে পদ ছাড়তে উৎসাহ জোগানো হবে।

এদিকে আগামীকাল বৃহস্পতিবার ঢাকায় ধানের শীষের প্রার্থীদের জরুরি বৈঠক ডেকেছে বিএনপি। ওই দিন সকাল ১০টায় গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এই বৈঠক হবে বলে জানিয়েছেন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। গতকাল সকালে বিএনপির দপ্তর থেকে নির্বাচনের অনিয়ম, কারচুপি, পোলিং এজেন্ট ও নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, নির্বাচনী সহিংসতায় আহত ও নিহতদের তালিকা, প্রতিটি কেন্দ্রের অস্বাভাবিক ভোটের হিসাবসহ ৮টি বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ দিয়ে একটি প্রতিবেদনও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বরাবর জমা দেওয়ার জন্য প্রার্থীদের কাছে জরুরি বার্তা পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে ভোটের দিন ব্যালট পেপারে সিল মারাসহ ভোট কারচুপির ভিডিও ফুটেজ থাকলেও তা-ও প্রতিবেদনের সঙ্গে যুক্ত করতে বলা হয়েছে।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment